চার মাস আগের ঘটনা। তখনও রশিদ আলি থাকতেন মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের মংডু গ্রামে। একদিন নামাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় স্থানীয় এক মাদ্রাসার হুজুরের সঙ্গে। এই হুজুরের কাছেই ছোটবেলায় কোরআন তেলাওয়াত শিখেছিলেন আলি। হালকা আলাপ শেষে হুজুর তাকে অদ্ভুত এক অনুরোধ করে বসলেন। আর অনুরোধটা এমন যে, এটি রাখতেই হবে। নয়তো প্রাণ যাবে তার! হুজুর মূলত তাকে বললেন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভাশন আর্মিতে (আরসা) যোগ দিতে।
উল্লেখ্য, প্রথম দিকে আরসা’র নাম ছিল ‘হারাকাহ আল-ইয়াকিন’ অথবা বিশ্বাসের আন্দোলন। সংগঠনটি প্রথমে পরিচিতি লাভ করে গত বছরের ৯ই অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী পুলিশের ওপর একযোগে হামলা চালানোর মাধ্যমে। আলি সেদিনকার স্মৃতিচারণা করে বলছিলেন, ‘হুজুর আমাকে বললেন যে, ধর্ম রক্ষা করতে হলে, আমাদেরকে আরসা’য় যোগ দিতে হবে। আমাদের ধর্মের ওপর এই রাষ্ট্র (মিয়ানমার) আক্রমণ করছে। আর আরসা আমাদের অধিকার রক্ষা করতে যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধই পারে আমাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে।’
আলি এখন থাকেন কক্সবাজারের এক শরণার্থী শিবিরে। রাখাইনে ২৫শে আগস্ট আরসা’র আক্রমণের পর যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তা থেকে বাচঁতে বাংলাদেশে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। আলি তাদেরই একজন। সেদিন থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী (‘তাতমাদাও’) রাখাইনে এক নৃশংস ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ (নিধন অভিযান) চালানো শুরু করে।
২১ বছর বয়সী আলির ভাষ্য, আরসা’য় যোগ দেওয়া ছাড়া তার আর কোনো পথ ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আমি যদি যোগ না দিই, তাহলে আমাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। হুজুর নিজে নিশ্চিত করবেন যাতে সম্প্রদায়ের সবাই আমাকে পরিত্যাগ করে। এমনকি আমাকে হত্যাও করা হতে পারে।’
আলি দাবি করেন, তিনি আরসা থেকে কোনো ধরণের সামরিক প্রশিক্ষণ পান নি। এমনকি আরসা’র সামরিক পরিকল্পনা সম্বন্ধেও তার কোনো ধারণা ছিল না। তিনি আরসা’র মাত্র সাতজন সদস্যকে চিনতেন। তারা সবাই তার গ্রামেরই লোক। আরসা’র হয়ে ওই হুজুরই তাকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন। সংগঠনের ভেতরের খবরা-খবর তিনি জানেন না। তার কাজ ছিল একটাই: রোহিঙ্গাদের ভেতর সরকারের যেসব চর (ইনফরমার) আছে, তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা। তাদের বিভিন্ন বৈঠক ও পদক্ষেপ সম্পর্কে হুজুরকে অবহিত করা।
গত বছরের অক্টোবর থেকে রাখাইনে আরসা’র তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। এরপর থেকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামে কয়েক ডজন গ্রাম্য প্রশাসক ও ব্যক্তিকে সরকারের চর সন্দেহে খুন করা হয়। অনেকের ধারণা এসব আরসা’র কাজ। তবে আলি জানিয়েছেন, তাকে যে চার জন চরের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বলা হয়েছিল, তাদের কেউ খুন হয়নি। এমনকি তারা এখন বাংলাদেশে আছেন শরণার্থী সেজে। আলি যেই শিবিরে অবস্থান করছেন ঠিক সেখানেই!
রশিদ আলির একমাস আগে দোকানদার আহমেদ জামাল (২৫) আরসা’য় যোগ দেন। তিনি বলেন, আল-ইয়াকিনের (আরসা) লোকেরা আমাদের গ্রামে (মংডু) সংগঠনে যোগ দেয়ার আহবান জানায়। তাদেরকে পছন্দ হয় আমার। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা আমাদের নাগরিকত্ব ও অধিকার ফিরিয়ে দেবে। এছাড়া গ্রামের মুরুব্বীদের কেউ কেউ আরসা’র কিছু সদস্যকে চিনতেন। মুরব্বীরাও আমাদেরকে আরসা’য় যোগ দিতে বললেন।
জামালের ভাষ্যমতে, তার গ্রাম থেকে প্রায় ১০০ জন আরসা’য় যোগ দেয়। তাদের বেশিরভাগই ছিলো তার বন্ধু বা পরিচিত। আলির মতো জামালও কোন সামরিক প্রশিক্ষণ পান নি। গুটিকয়েক আরসা সদস্য ও তার হ্যান্ডলারের (নির্দেশক) সঙ্গেই জামালের যোগাযোগ ছিল। যোগদানের পর জামালকে গ্রাম-প্রহরীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তার প্রধান কাজ ছিল বিজিপি (সীমান্তরক্ষী) বা সেনাদের দেখলেই গ্রামবাসীদের সতর্ক করে দেয়া। পাশাপাশি গ্রামের মানুষ যেন ধর্মকর্ম করে সেই খেয়াল রাখা। কাউকে নামাজের সময় মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি করতে দেখলে, তাদেরকে নামাজ পড়তে বলা।
আলি ও জামাল উভয়ের দাবি, ২৫শে আগস্ট আরসা’র ওই হামলার খবর আগে থেকে তারা জানতেন না। বাকি সবার মতো, হামলার পর তারা জেনেছেন। ততদিনে সেনাবাহিনী তাদের নিধন অভিযান্ শুরু করে দিয়েছে। জামাল সেদিনকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘হামলার পরের দিন বিজিপি সদস্যরা আমাদের গ্রামে আসে। কিছু রোহিঙ্গাও তাদের সহায়তা করে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে শুধু লাঠি আর ছুরি ছাড়া কিছুই ছিল না। আমরা লড়াই করতে পারিনি, তাই পালিয়েছি। আমার ভাইকে বিজিপি গুলি করে। তাকে বয়ে নিয়ে আসতে হয় আমার। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানোর আগেই সে মারা যায়। আমি নিজে চারজনকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি। গ্রামের সবাই পালিয়েছে। বিজিপি সদস্যরা আমাদের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।’

উত্তর রাখাইনের মংডুর কাছে অবস্থান করছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক সদস্য। ছবিটি সেপ্টেম্বরে তোলা। (রয়টার্স)
অপরদিকে রশিদ আলির গ্রামে সেনাবাহিনী হামলা চালায় ২৬শে আগস্ট সকালের দিকে, অর্থাৎ হামলার ঠিক পর দিন। পরিবারের সবাইকে ফেলে রেখে আলি একাই বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। পরদিন তিনি জানতে পারেন পাশের এক পুকুরে তার পরিবার লুকিয়ে আছে। সেখান থেকে সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আলি।
আরসার নেতারা হামলা সম্পর্কে আগেভাগে কিছু না জানানোয়, আলি ও জামাল উভয়েই খুব ক্ষুদ্ধ। আলি বলেন, ‘নেতাদেরকে এখন পেলে জিজ্ঞেস করতাম, কেন আপনারা এমন করলেন? আপনারা জানতেন যে, আমরা জিততে পারবো না এই যুদ্ধে। আপনারা জানতেন যে, তাতমাদাও (সামরিক বাহিনী) ও বিজিপি আমাদেরকে গণহারে হত্যা করবে। তাদের বদলে আপনারাই আমাদের সরাসরি হত্যা করলেন না কেন?’
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) তথ্য অনুসারে, আরসা’র কমিটি গঠন হয় সৌদি আরবে। সংগঠনটির নেতা আতা উল্লাহ পাকিস্তানে জন্ম নেয়া ও সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা একজন রোহিঙ্গা। নিজেদের বিভিন্ন বিবৃতিতে আরসা বারবার রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘হারাকাহ আল-ইয়াকিনে’র মতো আরবী নাম বদলে ‘আরসা’ নামকরণেও এই বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটে।
অপরদিকে আহমেদ জামাল ও রশিদ আলির কাহিনী থেকে এটি বোঝা যায় যে, আরসা’র বিদ্রোহে ধর্মের ভূমিকা বেশ প্রবল। অন্তত, তারা যতটা বলে থাকে, তার চেয়েও বেশি। আবার দলটির মধ্যে অতটা জিহাদী মতাদর্শের প্রভাব দেখা যায় না। বিভিন্ন বিবৃতিতে আরসা বেশ জোর দিয়েই দাবি করে থাকে যে, কোন স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে মিয়ানমার সরকার বরাবরই সংগঠনটির গায়ে ‘জঙ্গিবাদে’র তকমা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও সরকার নিজেদের দাবির স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ সরবরাহ করতে পারে নি।
এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, মিয়ানমারে বহু আগ থেকেই নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস অতটা পুরোনো নয়। আরসা’র উত্থান হলো রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অত্যাচারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ২০১২ সালে রাখাইনে কয়েক দফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর, রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার নৃশংস রূপ ধারণ করে। বহুদিন ধরে সামরিক শাসনাধীন থাকা মিয়ানমারে সম্প্রতি গণতন্ত্র এলেও, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা আগের চেয়েও বেড়েছে।
২০১২ সালের সহিংসতার পর থেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আটক করা হয় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে। আর তখন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের খবর ব্যপকভাবে উঠে আসতে থাকে। মিয়ানমারের ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের গণনাই করা হয়নি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি। উল্লেখ্য, ওই নির্বাচনে জয়ী হয়েই অং সান সুচি’র দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ ক্ষমতায় আসে। এবং সুচি হয়ে ওঠেন আধা-গণতান্ত্রিক দেশটির বেসামরিক সরকারের প্রধান। নোবেল বিজয়ী সু চি’র দল থেকে গত নির্বাচনে কোনো মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক নিধনযজ্ঞে নিষ্ক্রিয় থাকায় সু চি সরকার বিশ্বজুড়ে ব্যপক নিন্দা কুড়িয়েছে।
আলি ও জামাল উভয়েই মনে করেন, আরসার বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের দরুণ রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তারা দু’জনই একমত যে, ২৫শে আগস্ট আরসা’র ওই হামলার কারণেই সামরিক বাহিনী সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর পাল্টা হামলা চালানোর সুযোগ পেয়েছে।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, সামরিক বাহিনীর ওই কথিত অভিযান মূলত ‘জাতিগত নিধনে’র (এথনিক ক্লিনজিং) শামিল। আলির বিশ্বাস, আরসা জেনেশুনেই চেয়েছে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযান চালাক। ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এক আরসা কমান্ডারকে উদ্ধৃত করা হয়। তিনি বলছিলেন, ‘কিছু পেতে হলে, কিছু হারাতে হয়। আমরা ৭০ বছর ধরেই মরছি। অন্তত, এখন আমাদের মৃত্যু বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে।’
আগস্টের পর থেকে আরসা আর বড় কোনো হামলা চালায়নি। এমনকি ৯ই অক্টোবর তাদের একপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পরও নয়। এই সংগঠনটির পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা অনুমান করা অসম্ভব। আবার, আগের মতো বড় হামলা চালানোর সামর্থ্য তাদের আছে কিনা তা-ও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। দলটির প্রতি রোহিঙ্গাদের সমর্থন এখন কতটা রয়েছে, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বাস করা কয়েকজন রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ তাদের এই দুর্দশার জন্য আরসা’কে দায়ী করেছেন। অন্যরা অবশ্য বলেছেন যে, তারা আরসা’কে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেখেন। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলো এখন আরসা সদস্যদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তারা শিবিরে অবস্থানরত অসংখ্য হতাশ-বিক্ষুদ্ধ রোহিঙ্গা তরুণদের রিক্রুট করে শিগগিরই নতুন করে মাথাচাড়া দিতে পারে। রাখাইনের বুথিংডাও পৌরসভার বাসিন্দা ফাতিমা (৫০) আরসা সম্পর্কে বলেন, ‘তারা আমাদেরই লোক। তারা রোহিঙ্গাদের জন্মভূমি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লড়াই করে মরতে রাজি আছি।’
তবে আরসার প্রতি আহমেদ জামালের অনুভূতি ফাতিমার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। জামাল মনে করেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। নিজের রিক্রুটকারীকে জামাল একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অস্ত্র কবে পাবেন তিনি। সেই কথোপকথনের বর্ণনা দিয়ে জামাল বলেন, ‘তিনি জবাবে বলেছিলেন যে, চিন্তা করতে হবে না। তাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, কোনো এক সময় অস্ত্র পাবোই। কিন্তু আমরা কখনোই তা পাইনি।’ তিক্ত এই অভিজ্ঞতা নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসা জামাল আরও বলেন, তিনি এখন আর নিজেকে আরসা’র সদস্য ভাবেন না। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার বিষয়ে তার অবস্থান আগের মতোই আছে। জোর দিয়েই বললেন, ‘অস্ত্র হাতে পেলে আমি সংগ্রামে যোগ দেবো, ওই অস্ত্র যেখান থেকেই আসুক না কেন!’
(এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে। মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন কার্লোস সারদিয়া গ্যালাস।)